ষড়ঋতুর এই দেশে বৃষ্টি এবং বর্ষা নিয়ে আমাদের আবেগ আর আগ্রহ শিশুর মত সরল । নৈসর্গিক প্রকৃতি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে তার রুপ, সৌন্দর্য দেখার জন্য । বৃষ্টি, বর্ষা, নদী-নালা, হাওর-বাওর, বাঙালির আবেগ, সাহিত্য এমনকি খাদ্যাভ্যাস জুড়ে আছে এর বিচরণ। তেমনি বর্ষাকালে ভ্রমণ করাটাও বর্ষার আরেক যাদুকরী মুগ্ধতার আনন্দময় পরিণতি। বর্ষাকালে বাংলাদেশের সকল ভ্রমণ স্থানগুলো সমান পূর্ণতা না পেলেও কিছু দর্শনীয় স্থান যেন নতুন করে যৌবন ফিরে পায়। এমন কিছু জায়গা আছে যা শুধু বর্ষাকালেই আসল সৌন্দর্য মেলে ধরে। আর সেই সকল স্থানে ভীড় করে হাজার-হাজার পর্যটক। নাড়িয়ার আজকের আয়োজনে জেনে নেয়া যাক বর্ষাকালে দেশে ভ্রমণের সেরা ৮ দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

🌳টাংগুয়ার হাওর:

টাংগুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত বাংলাদেশের এক বিশাল শীতল জলাভূমির নাম। এটি বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই হাওরটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামেও পরিচিত। প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই হাওরে রয়েছে প্রায় ৪৬টি গ্রাম। বর্ষায় হাওরের সব কিছু ডুবে যায়, তখন এই গ্রাম গুলোকে দ্বীপ বলে মনে হয়। দূরে মেঘালয়ের সারিসারি দৃষ্টি নন্দন পাহাড়গুলো টাংগুয়ার হাওরকে দিয়েছে এক ভূবন মোহ্নীয় নৈসর্গিক রুপ, যা কখনো ভুলার নয় । পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ছোট বড় প্রায় ৩০ ঝর্ণা এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই বেড়ে উঠা বিশাল এই জলাভূমি প্রতিটি মৌসুমেই তার রুপের পরিবর্তন করে। টাঙ্গুয়ার হাওর দেখবেন কখনো আয়নার মত স্বচ্ছ আবার দেখবেন আকাশের মত নীল। নীল আকাশের সাদা মেঘের খেলা দেখবেন স্বচ্ছ জলের মাঝে। 

🌳হাকালুকি হাওর:

হাকালুকি হাওর

হাকালুকি হাওর প্রাকৃতিক সৌদর্র্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি । ১৮ হাজার হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত এই হাওর পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় ও পূর্বে পাথারিয়া মাধব পাহাড় বেষ্টিত হাকালুকি হাওড় সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫ টি উপজেলায় বিস্তৃত এই হাওর বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি। বর্ষায় হাওড়ের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওড়ের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি সত্যই দৃষ্টিনন্দন ও মনঃমুগ্ধকর। শীত কালে হাওড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যকে সমৃৃদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের অতিথি পাখির আগমন ও কলরব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসে এই হাকালুকি হাওরে খাদ্য ও আবাসস্থলের সন্ধানে এবং বেছে নেয় বিভিন্ন বিল, নদী, খাল, কৃষিভূমি ও বিস্তৃত প্রান্তর তাদের শীতকালীন নিরাপদ আবাসস্থল রুপে। হাকালুকি হাওড় পরিণত হয় দেশীয় ও অতিথি পাখির মিলন কেন্দ্রে।

🌳নিকলী হাওর:

নিকলী হাওর

দ্বিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির বুকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ নিকলী হাওর ছাড়া কোথাও খুঁজে পাবেন না । ঢাকার নিকটবর্তী ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলার প্রায় সবটুকু এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ নিকলী হাওর। কিশোরগন্জ জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্ব দিকে তার অবস্থান।এখানে রোদা নদী, সোয়াইজনী, নরসুন্দা, ধনু আর ঘোরাউত্রা হাওরের পানিতে একাকার হয়ে সমদ্রের রূপ ধারণ করেছে। আবহমান বাংলায় বর্ষার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে চিত্রটি আমরা কল্পনা করি তার পরিপূর্ণ রূপটি পাওয়া যায় হাওর জনপদ নিকলীতে। রাতের হাওর বিচিত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়। নিশুতি রাত, স্বচ্ছ জলে চাঁদের আঁচড়ে পড়া আলো আর নৌকার গাঁয়ে হাওড়ের অবিরাম জলকেলি ব্যতীত আর কোন সাড়াশব্দ কিংবা আলো চোখে পড়বে না। এ এক অপার সৌন্দর্য। এমনি এক ঘোরে রাত কাটিয়ে সকালে চোখে পড়বে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলের দল মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে হাওড়ের বুকে। আর পানিতে সূর্যোদয়ের লাল আভার ছন্দবদ্ধ আবেগ।

🌳চলন বিল:

চলন বিল

চলনবিল বলতে চলমান (চলন্ত) বিলকে বোঝায়। অর্থাৎ যে বিল প্রবাহমান। বিল সাধারণত বদ্ধ থাকে, তবে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। গঠিত হওয়ার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার থাকলেও বর্তমানে চলনবিলের আয়তন ১১৫০ বর্গকিলোমিটার। চলন বিল (Chalan Beel) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমিগুলির একটি। দেশের সর্ববৃহৎ এই বিলটি বিভিন্ন খাল বা জলখাত দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলি ছোট ছোট বিলের সমষ্টি।শীত এবং বর্ষা কালে এই বিলের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায় । চারিদিকে অথই জলরাশি, পরিস্কার জল, গভীর রাতে জেলেদের নৌকা নিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। চলন বিল দেখার পরে দেখে নিতে পারেন গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে অবস্থিত চলনবিল জাদুঘরটিও।

🌳কাপ্তাই লেক:

কাপ্তাই লেক

দুপাশে চিরহরিৎ গাছপালায় বেষ্টিত চোখ ধাঁধানো সবুজ পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হ্রদ। চারপাশ জুড়ে শুধু বিমুগ্ধ হওয়ার মত দৃশ্য! প্রকৃতি কতটা অকৃপণ হাতে তার রূপসুধা ঢেলে দিয়েছে তা দেখতে ও অনুধাবন করে হারিয়ে যেতে কাপ্তাই লেকের তুলনা হয় না। বিস্তীর্ণ জলরাশি , নীল আকাশ আর ছোট ছোট পাহাড়, লেকের মাঝে ছোট ছোট টিলায় বাড়ি গুলো  মিশে তৈরি করছে শিল্পীর আঁকা যেন একটি ছবি। এই সৌন্দর্য্য আপনাকেই মুগ্ধ করবেই প্রকৃতির আপন মহিমায়। পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই (Kaptai) উপজেলায় রয়েছে এশিয়ার সবচাইতে বড় লেক কাপ্তাই লেক। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি ঝর্ণা, লেকের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা এবং ছোট ছোট পাহাড়ের মুগ্ধকর সৌন্দর্য আপনার জীবনে বয়ে আনবে অনাবিল আনন্দ। কৃত্রিম এই হ্রদটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড়। এই লেকের একদিকে পাহাড়গুলোতে যেমন আছে সবুজে ঘেরা গাছের সমারোহ, অপরদিকে লেকের জলে রয়েছে বহু প্রজাতির মাছ।

🌳হাইল হাওর:

হাইল হাওর

হাওরের চিরায়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীল আকাশ ও পানির মিতালী যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির বাস্তব রূপ। সেকারণে হাওড়ের বুকে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে সারাদেশের ভ্রমণকারীরা এই ভূস্বর্গে ছুটে আসেন। শীতকালে হাওরগুলি বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরের রূপ নেয়, আবার বর্ষাকালে কুলহীন সমুদ্রের আকার ধারণ করে। হাইল হাওরের অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্রেরও কোন ঘাটতি নেই। এই হাওরে প্রায় ৯৮ প্রজাতির মাছ ও প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণ লক্ষ করা যায়। এখানে মাছের বংশ বিস্তারের সাথে সাথে সমাগম ঘটছে হাজার হাজার বিদেশী পাখির। প্রস্ফুটিত পদ্ম আর বিরল প্রজাতির নীলপদ্ম এবং শাপলা শালুকে এখন অপরূপ রূপ ধারণ করেছে বাইক্কা বিল। জীববৈচিত্র ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হাইল হাওরের বাইক্কা বিল এখন জলজ সম্পদের অমূল্য ভান্ডার।

🌳ডিঙ্গাপোতা হাওর:

ডিঙ্গাপোতা হাওর

প্রকৃতির রূপসী কন্যা বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলা নিকেতন এই বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে সাজিয়ে রেখেছে শ্যামল বাংলাকে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মেলাঘর বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনার উর্বর ক্ষেত্র এ দেশ। হাওর কখনো সবুজ কখনো সাগর। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে সবুজের ঢেউ খেলে যায় আবার বর্ষায় সেখানে জলকেলি চলে। প্রতিটি হাওর যেমন নয়নাভিরাম তেমনি সৌন্দর্যমণ্ডিত। ডিঙ্গাপোতা হাওর পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার দুয়ার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপসুধা আকণ্ঠ পান করতে শরতের জ্যোত্স্নালোকিত রাতে শরত্ শশীর আলোর ঝলকানি অবলোকন করতে হিজল করচের গলাপানি ডোবা সারি দেখতে আধোডোবা হিজল ছায়ায় শীতল বায়ে মন জুড়াতে ছুটে চলে মন ডিঙ্গাপোতা  হাওর পানে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাক্ষেত্র বাংলাদেশ। আর এই বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে হাওর অঞ্চল। এসব হাওরগুলোর প্রাকৃতিক মনোলোভা সৌন্দর্য সবসময়ই ভ্রমণ পিয়াসুদের হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়।বর্ষার জলে ভাসা হাওরের পানে মনটা ছুটে যেতে চায় বার বার। হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ, এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে অবলোকন করতে চাইলে যেতে হবে হাওরে। আর ঠিক এমনই মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা হাওর ডিঙ্গাপোতা হাওর। ডিঙ্গাপোতা হাওর আমাদের দেশের বড় বড় হাওরগুলোর মধ্যে একটি। এটি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে অবস্থিত। বর্ষাকালে এই হাওরের জলের ঢেউ আর হেমন্তে দুই ধারে থাকা সোনালি-সবুজে মাখা ধান দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় পর্যটকদের। এই হাওর পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার। 

🌳ধরন্তি হাওর:

ধরন্তি হাওর

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একরাশ জলাভূমির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ধরন্তি হাওর । স্থানীয়রা এটিকে আকাশি হাওড়ও বলে থাকেন। ধরন্তি হাওরের নৈসর্গিক এই সৌন্দর্য উপভোগ প্রতিদিন ভিড় করেছ হাজারো বিনোদন পিপাসু মানুষ। শাপলা বিলের দিগন্ত জোড়া থৈ থৈ পানি আর মেঘের লুকোচুরি খেলায় বর্ষায় বিকেলটা যেন আরো মোহময় হয়ে উঠে ভ্রমণ প্রিয় এই মানুষগুলোর মনে। সূর্যের আলোয় চিকচিক জলরাশির পেট কেটে চলে গেছে সরাইল-নাসিরনগর সড়ক।  নৈসর্গিক ধরন্তি হাওরের পূর্ব দিকে তিতাস নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী সহ ছোট বড় আরও বেশকিছু খাল-বিল রয়েছে। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাওর থাকে পানিতে পূর্ণ।