পদ্মার পললে গড়া, মেঘনার মায়ায় ঘেরা, কীর্তিনাশা, পালং, আড়িয়াল খাঁ, জয়ন্তী ইত্যাদি নদীর জলে জড়ানো ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল বর্তমান শরীয়ত পুর জেলার রয়েছে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। 

ইতিহাস সমৃদ্ধ বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল এবং প্রাচীন বরিশালের ইদিলপুর পরগনার কিছু অংশ নিয়ে বর্তমান শরীয়তপুর জেলা গঠিত।

বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামে নামকরণকৃত এ অঞ্চলটি পদ্মা নদীর দক্ষিণে বদ্বীপ অঞ্চল পর্যন্ত ছিল । সময়ের আবর্তে ১৯৭৭ সালে ৩ই নভেম্বর মহকুমা এবং সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে পৃথক জেলা হিসেবে আত্ব প্রকাশ করে ।  

মোদের গরব, মোদের আশা … বাংলাভাষা খ্যাত কবি অতুলপ্রসাদ সেন, ঔপন্যাসিক আবু ইসহাক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা পুলিন বিহারী দাশের জন্মস্থান বর্তমান শরিয়তপুর জেলা। শরিয়তপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম, বুড়ির হাট মুন্সী বাড়ী ও মসজিদ, রুদ্রকর মঠ, শিবলিঙ্গ, মহিষারের দীঘি, হাটুরিয়া জমিদার বাড়ি, রাম সাধুর আশ্রমধানুকার মনসা বাড়ি বেশ জনপ্রিয়।

🕌 মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডম – শরীয়তপুর 🏡

মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডম – শরীয়তপুর

ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১১ সালে প্রায় ৫০ একর জমির ওপর নির্মান করা হয় বৃহত্তম ফরিদপুরের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম (Mordern Fantasi Kingdom)। শরীয়তপুরে নড়িয়া থানা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে কলুকাঠি গ্রামে মনোরম পরিবেশে মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডম নির্মিত হয়েছে। মূলত মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডম নির্মিত হয়েছে একটি সামাজিক বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে। দেশের উন্নত বিনোদন কেন্দ্রের মত এখানে ও আধুনিক বিনোদনের সকল ব্যবস্থা আছে।

বিনোদনের জন্য এখানে বিভিন্ন রাইড, মিনি চিড়িয়াখানাসহ এর নান্দনিক সৌন্দর্য যে কোন মানুষকে আকর্ষন করে। শিশুদের জন্য রয়েছে সুপার চেয়ার, স্পীড বোট, শিশু রাইড, ওয়াটার হুইল, ট্রেন, ক্যাবল কার, ওয়াটার রাইট, মেরি গ্রাউন্ডসহ মজার মজার সব রাইড। এছাড়া রয়েছে দু’টি খেলার মাঠ এবং একটি বিশালাকার পুকুর। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ওষুধি গাছ।

মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডমের সবচেয়ে আকর্ষণ বিশালাকৃতির ৩টি খাঁচায় সুন্দরবনের ২০টি হরিণ, সঙ্গে হরিণ শাবক। এছাড়া রয়েছে একটি বিশাল অজগর সাপ, দুটি কুমির, ২০টির মতো বানর, ১টি চিতাবাঘ, ২টি ময়ূর, একটি সজারু, ২টি ভাল্লুক, ৭টি কচ্ছপ, ২টি উটপখি, ২টি ইমু পাখি, ১টি কালিম পাখি, ৮টি খরগোশ, ৩০টি গিনিপিগ, ২টি সজারু, ২টি বক্সার ডক এবং অ্যাকুরিয়ামে বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

শুধু বিনোদন কেন্দ্রই নয়  বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও বনভোজনের ব্যবস্থাও রয়েছে এ মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডমে। দর্শনার্থীদের জন্য সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে মর্ডান ফ্যান্টাসি কিংডম।

🕌 বুড়ির হাট মসজিদ – শরীয়তপুর 🏡

জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার বুড়ির হাট মসজিদটি(Burir Hat Masjid) খুবই বিখ্যাত এবং ইসলামী স্থাপত্যকলার নিদর্শন।জেলার প্রধান আর্কষন এই বুড়ির হাট মসজিদ। শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জ উপজেলার বুড়ির হাট বাজারে এই মসজিদের অবস্থান। প্রায় অনুমানিক ১০০ বছর আগের তৈরি মসজিদটি ইসলামিক স্থাপত্য কলার এক অপূর্ব নির্দশন। মাঝির ঘাট থেকে বাসে সদর হয়ে এই বুড়ির হাট মসজিদে আসা যায়।

🕌 রুদ্রকর মঠ – শরীয়তপুর🏡

রুদ্রকর মঠ – শরীয়তপুর

দেড়শত বছরের পুরনো এই মঠটি শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নে(Rudraqar Math) অবস্থিত।ঐতিহাসিক বিশিষ্ট স্থানের মধ্যে অন্যতম এটি। এখানকার হিন্দুগণ দেশ বিভাগের পূর্বে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। এখানকার মঠ বিখ্যাত। প্রতি বছরই এখানে সাড়ম্বরে পূজা ও কীর্তন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।এই মঠটি দেখার জন্য বহু লোক আসে।

🌳মহিষারের দিগম্বরী দীঘি – শরীয়তপুর🏝

মহিষারের দিগম্বরী দীঘি – শরীয়তপুর

ছয়শ’ বছরের পুরনো শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষারের দিগম্বরীর সন্যাসীবাড়ি ও দিগম্বরী দীঘিটি(Mahisarer Digambari Dighi) বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান ও বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত।

মোগল আমলের স্বাধীন ১২ ভূঁইয়ার একজন বিক্রমপুর পরগনার জমিদার রাজা চাঁদ রায় দিগম্বরীর সন্যাসীর অনুরোধে ১০ একর জমির ওপর এই দীঘি খনন করেন। ২৩ একর ৮৫ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে দিগম্বরীর পৈতৃক বাড়িসহ মেলা চত্বর, জোড়াপুকুর, মনসা মন্দির, কালী মন্দির চত্বর ও লক্ষ্মীন্দরের ঘরসহ অসংখ্য স্থাপনা। তাই ইতিহাসের অমর সাক্ষী দিগম্বরীর দীঘি ও এর আশপাশের এলাকাকে ঘিরে শরীয়তপুরের মহিষার হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা।

স্থানীয়রা জানান, যুগযুগ ধরে এখানে সপ্তাহে দু’দিন শনি ও মঙ্গলবার হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ পূজা ও মেলা হয়। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী এ মেলায় সমবেত হয়ে থাকে। প্রতি বছর শীতের সময় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি দেখা মেলে হাজার হাজার অতিথি পাখির। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা বিভিন্ন মানত নিয়ে এখানে আসেন। তাদের বিশ্বাস, দীঘির জলে স্নান করলে সব পাপ ও রোগমুক্তি ঘটে।

🏡ধানুকার মনসা বাড়ি – শরীয়তপুর🌳

ধানুকার মনসা বাড়ি – শরীয়তপুর

৬শ বছরের প্রাচীন এ বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে নানান অলৌকিক ও কিংবদন্তী লোক কথা। জেলার প্রাচীন ব্যক্তিগণ এ বাড়িকে ময়ুর ভট্টের বাড়ি নামে চিনে থাকেন।। সুলতানী ও মোগল আমলের নির্মাণ শৈলিতে নির্মিত এ বাড়িতে ৫টি ইমারত আছে ।

তৎকালীন সময়ে এখানে পূজা দেয়ার জন্য ভারতবর্ষের বহু লোকের আগমন ঘটতো বলে বাড়িটি মনসা বাড়ি(Dhanukar Manasa Bari) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ বাড়ির পাশে স্থাপিত ছিল মহিলা মনসা মন্দির ও শিব মন্দির। আরেক কিংবদন্তি থেকে জানা যায় ভারতের কৌনজ থেকে তৎকালিন সময়ে ধনাঢ্য ভট্রাচার্য পরিবার ধানুকা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তারা শিক্ষা, ধর্ম পরায়নতা, অর্থ বৃত্তে সমৃদ্ধ ছিল বলে জানা যায়। আর তাদেরই পূর্ব পুরুষ ছিলেন ময়ুর ভট্ট। ময়ুর ভট্টের জন্ম বৃত্তান্ত জানতে গিয়ে জানা যায় তিনি যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন তার পিতা মাতা তীর্থের জন্য কাশিধামে যাত্রা করেন। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা কি রূপ ছিল তা আজকের শরীয়তপুরবাসী অবশ্য কল্পনাও করতে পারবেনা।

দীর্ঘ যাত্রা পথে ময়ুর ভট্ট এক বনের ধারে জন্মগ্রহন করেন। তার ধর্মের জনক জননী ধর্ম ও দেবতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তারা পুত্রকে শাল পাতায় আচ্ছাদিত করে কাশিতে যাত্রা করেন। গন্তব্যে পৌছে পূজো দিয়ে রাতে ঘুমিয়ে তারা স্বপ্ন দেবতার মাধ্যমে জানতে পারে তাদের পূজা দেবতার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা শিশুটি ফেলে যাওয়ার সময় ভূলে গিয়েছিল মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। তারা তাদের ভূল বুঝতে পেরে দ্রুত ফিরে এসে দেখেন নির্দিষ্ট স্থানে এক ঝাক ময়ুর শিশুটিকে আচ্ছাদন করে রেখেছে। ময়ুরের আশ্রয়ে বেঁচে ছিল বলে ঐ শিশুর নাম রাখা হয়েছিল ময়ুর ভট্টো। তাঁর নামে বাড়ির নাম করন করা হয়।

🕌সুরেশ্বর দরবার শরীফ – শরীয়তপুর🏡

সুরেশ্বর দরবার শরীফ – শরীয়তপুর

ঐতিহ্যবাহী দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর(Sureswar Darbar Sharif) দ্বায়রা শরীফের ইতিহাস অতি সমৃদ্ধশালী। পদ্মা বিধৌত সুরেশ্বর গ্রাম বৃহত্তর ফরিদপুর বর্তমান শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানায় পদ্মা তীর থেকে প্রায় এক কিঃ মিঃ দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। বর্তমানে পদ্মা নদীর তীরের সাথেই এর অবস্থান। এর আগে ঢাকা জেলার বিক্রমপুর, খলিলাবাদ সুরেশ্বর পরগনা নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি চাঁদ রায়, কেদার রায় প্রমুখ হিন্দু শাসিত বৃহত্তর ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিল। বিক্রমপুর নামে এটা সমধিক পরিচিত ছিল।

সে সময় নড়িয়া থানা হয়নি, এর নাম ছিল পালং থানা। এর আগে থানার নাম ছিল লোন সিংহ। লোন সিংহ থানা ভাগ হয়ে পালং ও নড়িয়া থানা আলাদা হয়ে যায়। তখন মহকুমা ছিল মাদারীপুর, জেলা ছিল ফরিদপুর।

বৃটিশ শাসনামলে শাসন ব্যবস্থার সুবিধার্থে এ অঞ্চলটি ঢাকা জেলা থেকে পৃথক করে ফরিদপুর জেলার আওতায় আনা হয়। পূর্বেকার কাগজ-পত্রে এ অঞ্চল বিক্রমপুর ও খলিলাবাদ পরগনা নামে অতি সুপরিচিত। তবে ‘সুরেশ্বর’ নাম করণেরও এক আলাদা ইতিহাস রয়েছে।

🕌লাকার্তা জামে মসজিদ🏡

lakarta jame mosjid

শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী লাকার্তা গ্রামে অবস্থিত ৩শ বছরের পুরানো লাকার্তা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের নবরূপায়নের শেষে শুক্রবার শুভ উদ্বোধন করা হবে ।লাকার্তা সিকদার বাড়ীর সামনের এ মসজিদটি দীর্ঘ দুই বছর টানা প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করে মসজিদটিকে নামাজ আদায়ের উপযোগি করে তুলেছে। শরীয়তপুরে অনেক নয়নাভিরাম মসজিদ আছে কিন্তু এটার নির্মান কৌশল আসলেই অনেক সুন্দর। বিকালের স্নিগ্ধ আলোয় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম।