বাংলাদেশের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান মহাস্থানগড়। প্রাচীন এই পুরাকীর্তিটি রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলা থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি যার পূর্বে এর নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর এবং এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল।

🌳 ইতিহাস :

মহাস্থান’ মানে পবিত্র স্থান, এবং ‘গড়’ মানে দুর্গ। আজ থেকে প্রায় ২,৫০০ বছর আগে গড়ে ওঠা এই স্থানটি বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন (১0৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল । মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীল এর সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে অসেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। কারণ তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই এই দুই ভাইয়ের বিরোধের অবসান ঘটান এবং রাজা হন। এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল রাম। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম নামে পরিচিত। কথিত আছে পরশুরামের সাথে ফকির বেশি আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এর যুদ্ধ হয়। (১২0৫-১২২0) যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন।


মহাস্থানগড় বৌদ্ধ বিহারে যা দেখতে পাবেন

🌳মাহী সওয়ার মাজার শরীফ:

মাহী সওয়ার মাজার শরীফ

মহাস্থানগড় বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে একটি ঐতিহাসিক মাজার শরীফ রয়েছে। পীরজাদা হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) কে কেন্দ্র করে প্রাচীন এই মাজার শরীফটি গড়ে ওঠেছিল। কথিত আছে মাছের পিঠে আরোহন করে তিনি বরেন্দ্র ভূমিতে আসেন। তাই তাকে মাহী সওয়ার বলা হয়। প্রচলিত এক গল্প থেকে জানা যায়, হযরত মীর বোরহান নামক একজন মুসলমান এখানে বাস করতেন। পুত্র মানত করে গরু কোরবানী দেয়ার অপরাধে রাজা পরশুরাম তার বলির আদেশ দেন এবং তাকে সাহায্য করতেই মাছের পিঠে আরোহন করে মাহী সওয়ারেরর আগমন ঘটে।

🌳বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বা গোকুল মেধ:

বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বা গোকুল মেধ

ঐতিহাসিকদের মতে, মূলত এটি একটি বৌদ্ধ মঠ। সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে লোককাহিনী অনুযায়ী, এটি বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর নামে পরিচিত। চাঁদ সওদাগর তার ছেলে লখিন্দরকে দেবী মনসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এখানকার একটি গোপন কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখেন। বিয়ের রাতে বেহুলা এবং লখিন্দর গোপন কুঠুরিতে অবস্থান করা সত্ত্বেও সেখানে দেবী মনসার প্রেরিত সাপ প্রবেশ করে এবং লখিন্দরকে দংশন করে।

🌳 গোবিন্দ ভিটা:

গোবিন্দ ভিটা

মহাস্থানগড় জাদুঘরের ঠিক সামনেই গোবিন্দ ভিটা অবস্থিত। গোবিন্দ ভিটা একটি খননকৃত প্রত্নস্থল। গোবিন্দ ভিটা শব্দের অর্থ গোবিন্দ (হিন্দু দেবতা) তথা বিষ্ণুর আবাস। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন এ স্থানে পাওয়া যায়নি। তবুও প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত।

 🌳ভাসু বিহার:

ভাসু বিহার

ভাসু বিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। এটি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়, মহাস্থানগড় থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বিহার ইউনিয়নের ভাসু বিহার নামক গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়রা একে নরপতির ধাপ হিসেবে চেনে।ধারণা করা হয়, এটি একটি সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ। খননকার্যের ফলে সেখানে ব্রোঞ্জের বৌদ্ধমুর্তি, পোড়ামাটির ফলকসহ বিভিন্ন মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে।মহাস্থান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমের বিহার গ্রামটিতে বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধযুগীয় ইমারতের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নাগর নদের তীরে ৭০০৬০০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষকেই ১৮৭৯ সালে স্যার আলেকাজান্ডার কানিংহাম, হিউয়েন সাং বর্ণিত এবং ইতিহাসখ্যাত ভাসু বিহার বলে শনাক্ত করেছিলেন। দশম শতাব্দীতে নির্মিত বৌদ্ধ বিহার দুটোর মধ্যে একটি বড় অন্যটি ছোট। বড়টি উত্তর দিকে এবং ছোটটি দক্ষিণে অবস্থিত।

🌳পরশুরামের প্রাসাদ:


এখানে পাল আমলে নির্মিত ইমারতের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে এটি পরশুরামের প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত।

🌳ভীমের জাঙ্গাল:

ভীমের জাঙ্গাল

এটি একটি দীর্ঘ বাঁধ, যা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য রাজা ভীম কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এটি ইতালির বৃত্তাকার দুর্গের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আরো একটি মতানুসারে, এটি এ এলাকায় বন্যা থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। মহাস্থানগড়ের তিনদিক পর্যন্ত পরিবেষ্টিত এবং উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এখানে বহু মঠ রয়েছে।

🌳শীলাদেবীর ঘাট:

শীলাদেবীর ঘাট

গড়ের পূর্বপাশে রয়েছে করতোয়া নদী এর তীরে ‘শীলাদেবীর ঘাট’। শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের স্নান হয় এবং একদিনের একটি মেলা বসে।

🌳খোদার পাথর ভিটা:

খোদার পাথর ভিটা

এটি একটি লম্বা এবং আয়তাকার মসৃণ পাথর। ধারণা করা হয়, রাজা পরশুরাম এই পাথরকে বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। বর্তমানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক নারী এ পাথর দুধ এবং সিঁদুর দিয়ে স্নান করান। অনেকে খালি পায়ে দুধ ঢেলে ভক্তি নিবেদন করেন।

 🌳যাতায়াত:

ঢাকা থেকে খুব সহজে বাস অথবা ট্রেনে বগুড়া যাওয়া যায়। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রংপুর এক্সপ্রেস বা লালমনি এক্সপ্রেসেও বগুড়া যাওয়া যায়। বগুড়ার হাড্ডিপট্টি বা রেলস্টেশন থেকে খুব সহজেই বাসে বা অটোরিকশা নিয়ে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে মহাস্থানগড়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রতি বছর বহু পর্যটক এই স্থানে বেড়াতে আসেন।